সঠিক ডোজ নিচ্ছেন তো?
প্যারাসিটামলের ডোজ জানেন তো ? আমার এই নির্বোধের মতো প্রশ্নে ডাক্তার বন্ধু ভ্রু কুঁচকে তাকান। আমি আবারও বলি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কয়টা করে খাব? কেন ওখানে তো লিখেই দিয়েছি। একটা করে ভরা পেটে তিন বার। ডাক্তারী ভুলে গেলে? এবার তাঁর চেহারায় একটু বিরক্তি । বোধহয় মনে মনে কষে গাল মন্দ দেয়াও শুরু করেছে। বুঝতে পারি কথা বাড়িয়েও লাভ নেই। চলে আসি ভুল এক প্রেসক্রিপশনের ভুল ডোজে লেখা ওষুধ নিয়ে, আবারও ডাক্তারী শিখতে বসি।
বাসায় এসে প্রথমেই হাতে নেই ‘BRITISH NATIONAL FORMULARY’ সংক্ষেপে BNF। স্পষ্ট করে লিখা বড়দের জন্য প্যারাসিটামলের ৫০০ মি.গ্রা এর দু’টো ট্যাবলেট। তবে আমার ডাক্তার বন্ধুটি কেন ৫০০ মিলি গ্রাম লিখলেন ? উনি কি আমাকে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ভেবে অর্ধেক ডোজ দিলেন? আবার আমার দুর্বল স্মরণশক্তির কথা মনে করিয়ে দিলেন! বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের ডোজ নিয়ে একটা পুরো ভলিউম লিখে ফেলা যায়। যথেচ্ছ এবং ভুল ডোজে লেখা প্রেসক্রিপশন দিয়ে প্রত্যেকদিন একেকটা পাহাড় তৈরী করা যায়। এটা কেন হয়? অধমের ধারণা মেডিকেল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়া ফার্মাকোলোজি। তাও অনেক থিওরীটিক্যালি। এর দু’বছর পরে মেডিসিন, যদিও মাঝখানের সময়টিতে পুরো দমেই চলে ওয়ার্ডে রোগী নিয়ে পড়ানো। তবে সে পড়ানো রোগ নির্নয়ের জন্য, চিকিৎসার নিদান খুঁজে নেয়ার জন্য নয়। ফল যা হবার তাই। শেষ পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির লিটারেচারেই ভরসা। লিটারেচারগুলোতে যে ভুল কথা লেখা থাকে তা নয়, তবে সেটুকুও পড়ার সময় কোথায় ?
যে কোন অসুখের কথাই ধরা হোক না কেন, রোগ নির্ণয়ে ডাক্তারের মুন্সিয়ানা থাকলেও ওষুধের ক্ষেত্রে এসে পপাৎ ধরনীতল। একটার জায়গায় আধখানা বা চারভাগের একভাগ, সকালেরটা রাত্রে, দুপুরেরটা সন্ধ্যায়, সেটা খাবারের আগে সেটা পরে, কলমের মাথায় যা খুশি আসলো লিখে দিলেই হলো।
আমার বাবাকে ডায়াবেটিসের জন্য একটা ওষুধের চারভাগের একভাগ দিনে চার বার করে দিয়েছেন। কপালগুনে এই ওষুধটি যে গবেষকদল আবিষ্কার করেছেন তাদের ক’জনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো প্যারিসে। ওষুধটির ডোজ দিনে দু’বার হচ্ছে সর্বনিম্ন ডোজ। ডাক্তার সাহবেকে সবিনয়ে জানালেই প্রথমে ক্ষুদ্ধ হলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে এবং ডায়াবেটিস নিয়ে বিশেষত : ওষুধটি নিয়ে আমার সামান্য পড়াশোনা আছে জানাতেই বলে উঠলেন , আমরা তো এ ডোজেই রেজাল্ট পাচ্ছি। বইয়ে এসব কথা লেখাই থাকে। আমাদের দেশের লোকের Body weight, Metabolism এর উপর ভিত্তি করে …।। বক্তৃতা শুনতে ইচ্ছে হল না। কানের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ‘রেজাল্ট পাচ্ছি’, রেজাল্ট পাচ্ছি’ কথা বাঁজতে থাকলো । কী রেজাল্ট? কীসের রেজাল্ট ? রেজাল্ট পাচ্ছেটা কে? মেডিকেল কলজে ছাত্র অবস্থায় পেটে পেপটিক আলসার ধরা পড়ল, ডাক্তার সাহেব প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন– Antacid Suspension. খাবার পর পরেই দিনে তিন চামচ করে তিনবার। পাঠক, বাক্যটি লক্ষ্য করুন –অর্থাৎ খাবার শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই Antacid Suspension গলনঃকরন করতে হবে। আমি শুরু করলাম তাই। Antacid এক ধরনের ক্ষার জাতীর দ্রব্য যা পাকস্থলীর অতিরিক্ত এসিডকে প্রশমন করে। পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। এর ফলে খাবারের সঙ্গে জীবানু ধবংস হয়ে যায়।সে কারণে Antacid জাতীয় ওষুধ খাবারের অন্ততঃ আধ ঘন্টা পর পর খেতে হয় , যেন পাকস্থলীতে নিঃসরিত এসিড জীবানু বিনাশের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। আমার ডাক্তার সাহেব আধঘন্টা কথাটা লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন। “রেজাল্ট পেলাম” আমি দুদিন পরে। ফুড পয়জনিং নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম।প্রফেসর সাহেব দেখতে এসে প্রেসক্রিপশন দেখে মহাখাপ্পা।আমাকে ধমকে বললেন, কয়েকদিন পর ডাক্তার হবে আর একটু লিফলেটটা পড়ে দেখবে না? ভুল তো মানুষই করে, যাচাই করে ওষুধ খাবে না!
আজকে তো যাচাই করতে গিয়েছিলাম। পেলাম বন্ধুর বিরক্তি। উত্তর দিতে অক্ষম চিকিৎসকের চমৎকার এ্যালিবাই “রেজাল্ট তো পাচ্ছি”।এতকিছুর পরেও বাসায় এসে বই খুলে সত্য মিথ্যা দেখার অবস্থা আমার আছে। জ্ঞানী চিকিৎসকদের সঙ্গে কিঞ্চিত তর্ক করার সাহসও আছে। কেননা দেশের চৌদ্দ কোটি মানুষের উদয়াস্ত পরিশ্রমের টাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজে ছয় বছর পড়েছি। আমি না হয় আমারটা যাচাই করলাম, কিন্তু যাদের পয়সায় যাচাই করার শক্তি হলো তাদের কি হবে?
বাংলাদেশে ‘Uterus’ এ অপারেশন করতে গিয়ে আসমা নামের মেয়েটির কিডনি কেটে ফেলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই ডাক্তার আজও পেট কাটেন। হাজারও আসমা পরম বিশ্বাসে মূল্যহীন শরীরটাকে মেলে দেয় অপারেশনের টেবিলে। সেই ডাক্তার ছুরি হাতে দাঁড়ান। ছাত্র ছাত্রী তাঁকে ঘিরে থাকে। চোখে স্বপ্ন আজ এক নতুন সার্জারী শিখবে। শিখেও ফেলে কিছু কিছু। শুধু একটা অতি গুরুত্বপূর্ন জিনিষ ছাড়া— “ভুল করলে ক্ষমা চাইতে হয় । ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়।” নইলে আসমারা যুগ যুগ ধরে “রেজাল্ট পেতে” থাকবে। যেই রেজাল্ট পাবার ইচ্ছে দুঃস্বপ্নেও কারো হয় না।